শরৎ সমিতি

Sarat samity

শরৎ সমিতির ইতিহাস

১৩৪৪ বঙ্গাদের ২ মাঘ (১৬ জানুয়ারি ১৯৩৮) শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় প্রয়াত হন। তার কিছুদিন পরে আশুতোষ কলেজে একটি শোকসভার আয়োজন করা হয় এবং ‘শরৎচন্দ্র স্মৃতি সমিতি’ গঠনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এর সভাপতি হন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং সহ-সভাপতি বাসন্তী দেবী, সুভাষচন্দ্র বসু ও শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। উমাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় সম্পাদক ও কোষাধ্যক্ষ নির্বাচিত হন। এই সমিতি অর্থ সংগ্রহ করে এবং শরৎচন্দ্র স্মারক বক্তৃতার আয়োজন ও বিশিষ্ট সাহিত্যিকদের শরৎ পদক প্রদানের জন্য সেই অর্থ কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কে অর্পণ করে। বর্তমান শরৎ সমিতি সুপ্রতিষ্ঠিত হলে শরৎচন্দ্র স্মৃতি সমিতির সম্পাদক উমাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় তাঁদের উদ্বৃত্ত অর্থ দান করেন। 

      শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ১৯৩৫ সালে দক্ষিণ কলকাতার অশ্বিনী দত্ত রোডে একটি বাড়ি নির্মাণ করে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। তখন তাঁর খ্যাতি দেশ ছাড়িয়ে বিদেশে ছড়িয়ে পড়লেও তিনি প্রতিবেশীদের সঙ্গে সহজভাবে মিশতেন। অল্প দিনের মধ্যেই তিনি তাঁদের আপনজন হয়ে ওঠেন। তাই তাঁর প্রয়াণের পর তাঁর স্মৃতিরক্ষায় পল্লির মানুষজন এগিয়ে আসেন। ক্ষেত্রপাল দাস ঘোষ, নির্মলচন্দ্র ভট্টাচার্য, গণনাথ রায়, অজয় রায়চৌধুরী প্রমুখের প্রচেষ্টায় শরৎ সমিতি গড়ে ওঠে এবং এর প্রথম সম্পাদক হন ক্ষেত্রপাল দাস ঘোষ। তিনি আমৃত্যু এই পদে ছিলেন। ১৯৪৬ সালে ‘সমিতি আইন’-এ শরৎ সমিতি রেজিস্ট্রীকৃত হয়। শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, অতুলচন্দ্র গুপ্ত, উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়, নরেন্দ্র দেব, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়, সুবোধচন্দ্র সেনগুপ্ত, প্রতাপচন্দ্র চন্দ্র, সুশীলকুমার মুখোপাধ্যায়, রবীন্দ্রকুমার দাশগুপ্ত, চিত্ততোষ মুখোপাধ্যায়, সব্যসাচী ভট্টাচার্য প্রমুখ ব্যক্তিরা এই প্রতিষ্ঠানের সভাপতির পদে ছিলেন। পৃষ্ঠপোষক রূপে সংযুক্ত ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল কৈলাসনাথ কাটজু, পদ্মজা নাইডু, হরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় এবং সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, প্রফুল্লচন্দ্র সেন প্রমুখ বিশিষ্টজনেরা। শরৎ সমিতির বর্তমান সভাপতি হলেন রামকুমার মুখোপাধ্যায় এবং পৃষ্ঠপোষক হাইকোর্টের প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি চিত্ততোষ মুখোপাধ্যায়। বর্তমানে সাধারণ সম্পাদক শ্যামলকুমার বসু।
 
      শরৎ সমিতির একটি অন্যতম লক্ষ্য ছিল দক্ষিণ কলকাতায় শরৎচন্দ্রের নামে একটি স্মৃতি সদন প্রতিষ্ঠা করা। শরৎচন্দ্র তাঁর বাড়ির অদূরে ত্রিকোণ পার্কে বহু সন্ধ্যা কাটাতেন। তাই এটিই উপযুক্ত স্থান হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। পৌরসংস্থা আনুকূল্যে পার্কে একটি শরৎ স্মৃতি সদন নির্মিত হয়। সদনের সভাঘরটি শরৎ সমিতির অর্থে নির্মিত হয়। এই সভাঘরে তিনশো আসন এবং একটি মঞ্চ রয়েছে। ত্রিকোণ পার্কে পৌরসংস্থার দানে এক খণ্ড জমিতে শরৎচন্দ্রের একটি আবক্ষ মূর্তিও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এছাড়াও কেওড়াতলা মহাশ্মশানে পৌরসংস্থা নির্মিত স্মৃতিসৌধের অভ্যন্তরে শরৎ সমিতি একটি মূর্তি স্থাপন করেছে। শরৎ সমিতি মহাজাতি সদনে শরৎচন্দ্রের একটি তৈলচিত্র‌ও দান করেছে। আর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো শরৎচন্দ্রের বাসভবন সংরক্ষণ এবং সেখানে শরৎচন্দ্রের স্মৃতিরক্ষা। শরৎচন্দ্রের বাসভবনে শরৎচন্দ্রের ভাই প্রকাশচন্দ্র বসবাস করতেন এবং তাঁর মৃত্যুর পর শরৎ সমিতি বাসভবনটি অধিগ্রহণের জন্য পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে অনুরোধ করে। কিছুকাল পরে সরকার বাসভবনটি অধিগ্রহণ করে এবং শরৎ সমিতিকে শরৎচন্দ্র বিষয়ে আলোচনা, প্রকাশনা এবং শরৎচন্দ্রের ব্যবহৃত জিনিসপত্রের প্রদর্শনী ইত্যাদির কাজে ব্যবহারের অনুমতি দেয়। এই ভাবেই এই বাসভবনটি শরৎচর্চার একটি কেন্দ্র হয়ে ওঠে। শরৎচন্দ্রের গ্রন্থের বিভিন্ন সংস্করণ, পাণ্ডুলিপি, মূল্যবান ছবি, মানপত্র, পাসপোর্ট, ব্যবহৃত পোশাক কলম, চশমা ইত্যাদি এখানে সংরক্ষণ করা হয়েছে। শীততাপনিয়ন্ত্রিত একটি সভাঘর আছে যেখানে নিয়মিত সাহিত্যসভা ‌ও শরৎচন্দ্র বিষয়ে আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। বছরে বেশ কয়েকটি স্মারক বক্তৃতার‌ও আয়োজন করা হয়।

      শরৎচন্দ্রের জীবিতকালে তাঁর গ্রন্থগুলি প্রকাশিত হত গুরুদাস চট্টোপাধ্যায় এন্ড সন্স থেকে। গ্রন্থগুলির বহু সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে। পুনর্মুদ্রিত‌ও হয়েছে নানা সময়ে। পরে বসুমতী সাহিত্য মন্দির কয়েক খণ্ডে শরৎ রচনাবলী সুলভে বিক্রয় করে। কিন্তু পরবর্তী সময়ে শরৎচন্দ্রের গ্রন্থগুলি দুর্মূল্য ও দুষ্প্রাপ্য হয়ে পড়ে এবং নানা ত্রুটিবিচ্যুতিও দেখা যায়। তখন শরৎ সমিতি শরৎচন্দ্রের শতবর্ষ উপলক্ষ্যে সুসম্পাদিত শরৎ রচনাবলী প্রকাশের উদ্যোগ নেয়। সুবোধচন্দ্র সেনগুপ্ত, দেবীপদ ভট্টাচার্য ও গোপালচন্দ্র রায়ের সম্পাদনায় পাঁচ খণ্ডে সেই রচনাবলী প্রকাশিত হয়।‌ ওই সময়ে শরৎ সমিতির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন শৈলেন্দ্রনাথ গুহরায় এবং যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সুশীল সোম। রচনাবলী ছাড়াও শরৎ সমিতি শরৎচন্দ্রের লেখা কিছু গ্রন্থ এবং শরৎ সাহিত্য নিয়ে লেখা কিছু আলোচনাগ্রন্থ প্রকাশ করেছে। শরৎ সমিতি ‘শরৎ স্মরণিকা’ নামে শরৎচন্দ্র বিষয়ক একটি পত্রিকা‌ও প্রকাশ করে।

      শরৎ সমিতির আর একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো শরৎ পুরস্কার, শরৎ অনুবাদ পুরস্কার এবং শরৎচর্চা ও গবেষণা পুরস্কার প্রদান করা। শরৎ পুরস্কারটির সূচনা ১৯৭৬ সালে। এটি বাংলা ভাষার বিশিষ্ট একজন সাহিত্যিককে সমগ্র সাহিত্য সৃষ্টির জন্য দেওয়া হয়। অনুবাদ পুরস্কারটি ১৯৯৫ সাল থেকে প্রবর্তিত হয়েছে। এটি শরৎচন্দ্রের গ্রন্থ ভিন্ন ভাষায় অনুবাদের জন্য দেওয়া হয়। শরৎচর্চা ও গবেষণা পুরস্কারটি শরৎচন্দ্রের জীবন ও সাহিত্যের উপর রচনা বা আলোচনার জন্য দেওয়া হয়।

DSC_0650a

      শরৎ সমিতি এছাড়া‌ও পাঠাগার রয়েছে। পাঠাগারে নানা ধ্রুপদি গ্রন্থ রয়েছে এবং বসে পড়ার ব্যবস্থাও আছে। ক্রীড়ার ক্ষেত্রেও শরৎ সমিতি দীর্ঘদিন যুক্ত আছে। শরৎ সমিতি ক্রিকেট টিম সি. এ. বি. অনুমোদিত এবং সেকেন্ড ডিভিসনে নানা ক্রীড়ায় অংশগ্রহণ করে। শরৎ সমিতি ফুটবল টিম এফ. এ. অনুমোদিত এবং ফিফথ ডিভিশনের ক্রীড়ায় যোগদান করে। ফুটবলের টিমটি ছোটোদের নিয়ে গঠিত হয়েছে। শরৎ সমিতি সামাজিক সেবামূলক কাজকর্মের সঙ্গে‌ও যুক্ত। একটি হোমিও ক্লিনিক পরিচালনা করে এবং বিনামূল্যে ঔষধ দেওয়া হয়। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় নিজেও হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা করতেন এবং এই অঞ্চলে ‘ডাক্তারবাবু’ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। সেই সূত্র ধরে এই চিকিৎসা ব্যবস্থা চালু রাখা হয়েছে।